You are currently viewing শনি মহারাজ নিয়ে কিছু কথা

শনি মহারাজ নিয়ে কিছু কথা

এমন লোক খুব কমই আছে যে শনির নাম শুনে ভীত হয় না । সূর্য দেবের নয় পুত্র এর মধ্যে শনির নাম বিশেষ উল্ল্যেখযোগ্য । সূর্য দেবের পত্নী ছায়ার পুত্র শনি দেবের গায়ের বর্ণ কালো । শনি ছোট বেলা থেকে বদ মেজাজি । সূর্য দেব নিজের রাজ্য তার পুত্র দের মাঝে ভাগ করে দিলেন । প্রত্যেক সন্তান কে এক এক লোকের অধিপতি করে দিলেন । শনি দেব এক লোকের অধিপতি হয়ে খুশি ছিলেন না । তাই তার ভাইদের কাছ থেকে রাজ্য কেড়ে নেবার পরিকল্পনা করলেন । অধিক শক্তি লাভের জন্য তিনি ব্রহ্মার তপস্যায় বসলেন তার তপস্যা সন্তুষ্ট হয়ে দেখা দিলেন । তিনি তাকে বর চাইতে বললেন । শনি দেব তখন বললেন……..
হে ভগবান ,আমার শুভ দৃষ্টি পড়লে যেমন কারো ধন সম্পত্তি ঘর সন্তান ইত্যাদি সুখি ও সম্পন্ন হয় তেমনি কু দৃষ্টি পড়লে যেন যার উপর পড়বে তার যেন সব ছারখার হয়ে যায় । ব্রহ্মা তাকে বর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন ।
শনি দেব শক্তি প্রাপ্ত হবার পর শনি দেব তাঁর ভাইদের রাজ্য ছিনয়ে নেওয়ার জন্য তৎপর হলেন । তখন অন্যান্য ভাইরা সবাই পিতা সূর্য দেবের স্মরণাপন্ন হলেন হলেন । সূর্য দেব তখন ভগবান শিবের স্মরণাপন্ন হলেন এবং প্রার্থনা করলেন । সূর্য দেবের প্রার্থনা শুনে শনি দেব কে মারার জন্য নন্দী ও বীরভদ্র কে পাঠালেন । এরা সবাই শনি দেবের কাছে পরাজিত হয়ে ফিরে এলেন । তখন শিব ক্রুদ্ধ হয়ে নিজেই শনির সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তৃতীয় নয়ন খুললেন । শনি তার মারক দৃষ্টি দিয়ে শিব কে দেখলেন । উভয়ের দিব্য দৃষ্ট জ্যোতিঃ সারা মহাকাশ আচ্ছাদিত হল । এবার শিব তাঁর ত্রিশূলের প্রহারে শনি অবচেতন করলেন । নিজ পুত্র কে মৃত ভেবে শোক গ্রস্ত হলেন এবং শনির জীবন দানের জন্য প্রার্থনা অনুনয় বিনিময় করতে লাগলেন । সূর্যের প্রার্থনা শুনে শিব শনির মুরচ্ছা ভঙ্গ করলেন । শনিদেবে অভিমান ভঙ্গ হল এবং ভগবানের পাদপদ্মে নিজেকে সমরপন করে ক্ষমা চাইলেন ।
শিব তখন প্রসন্ন হয়ে শনি দেব কে নিজের সেবক করে নিলেন এবং তাকে দণ্ডাধিকারি পদ দিলেন ।
শনি দেব ক্রূর হবার ওপর একটি কাহিনী আছে । একবার শনিদেবের পত্নী ঋতুমতী হলেন । ঋতু স্নানের পর তিনি পুত্র কামনায় নিজ পতি দেবের কাছে উপস্থিত হলেন । কৃষ্ণ ভক্ত শনিদেব ঐ সময় কৃষ্ণের ধ্যানে মগ্ন ছিলেন । তার পত্নীর ঋতু ব্যর্থ হয়ে গেল । তিনি রেগে গিয়ে শনিদেব কে অভিশাপ দিলেন যে তোমার দৃষ্টি যার উপর পড়বে তার সর্বনাশ হবে ।
শনির কু দৃষ্টি র কারনে মহাপ্রতাপি বেদজ্ঞ ও মহাপণ্ডিত রাবনের সর্বনাশ হয়েছিল । যদিও শিবের কাছে বর পেয়ে ছিলেন । সূর্য , কুবের , যম বায়ু তার অধিনে । একবার তিনি শনির সাম্রাজ্য আক্রমণ করে তাকে বন্দী করে বন্দী গৃহে তাকে উল্টো করে টাঙ্গিয়ে রাখলেন । রাবনের শক্তির কাছে শনি দেব অসহায় হয়ে পড়েন । কিছু কাল পর সীতা দেবীর খবর নেবার জন্য হনুমান জী লঙ্কায় গেলে শনিদেব তাকে বন্দী দশা থেকে মুক্ত করতে বলেন ।
হনুমান তাকে মুক্ত করলে তার দৃষ্টি তে লঙ্কা পুরি পুড়ে ছাই হয়ে যায় ।
শনিদেব সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা যতই ভয়ভীতিমিশ্রিত হোক না কেন, মৎস্য পুরাণ কিন্তু শনিদেবকে লোকহিতকর গ্রহের তালিকাতেই ফেলেছে। প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় শনিদেবের পূজার্চনা করার বিধান আছে। সাধারনত শনিদেবের মন্দিরে অথবা গৃহের বাইরে খোলা জায়গায় শনিদেবের পূজা হয়। নীল বা কৃষ্ণগ বর্ণের ঘট, পুষ্প, বস্ত্র, লৌহ, মাষ কলাই , কালো তিল, দুগ্ধ, গঙ্গাজল, সরষের তেল প্রভৃতি বস্তু শনিদেবের ব্রতের জন্য আবশ্যিক। নির্জলা উপবাস বা একাহারে থেকে এই ব্রত পালন করতে হয়।
শনি গ্রহদেবতা হিসেবে সবিশেষ পরিচিত। জ্যোতিষশাস্ত্রে জন্মছকে এর অবস্থান বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। শনি দ্বাদশে, জন্মরাশিতে ও দ্বিতীয়ে অবস্থানকালে সাড়ে সাত বছর মানুষকে প্রচণ্ড কষ্ট দেয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় শনি গ্রহ রূপে গুণে অসামান্য। তার কারণ, এই গ্রহকে ঘিরে থাকা চাকতিগুলি; যাকে আমরা বলি ‘শনির বলয়’। তুষারকণা, খুচরো পাথর আর ধূলিকণায় সৃষ্ট মোট নয়টি পূর্ণ ও তিনটি অর্ধবলয় শনিকে সর্বদা ঘিরে থাকে। শনি দৈত্যাকার গ্রহ; এর গড় ব্যাস পৃথিবীর তুলনায় নয় গুণ বড়। এর অভ্যন্তরভাগে আছে লোহা, নিকেল এবং সিলিকন ও অক্সিজেন মিশ্রিত পাথর। তার উপর যথাক্রমে একটি গভীর ধাতব হাইড্রোজেন স্তর, একটি তরল হাইড্রোজেন ও তরল হিলিয়াম স্তর এবং সবশেষে বাইরে একটি গ্যাসীয় স্তরের আস্তরণ।শনি গ্রহের রং হালকা হলুদ। এর কারণ শনির বায়ুমণ্ডলের উচ্চবর্তী স্তরে অবস্থিত অ্যামোনিয়া ক্রিস্টাল। শনির ধাতব হাইড্রোজেন স্তরে প্রবাহিত হয় এক ধরনের বিদ্যুত প্রবাহ। এই বিদ্যুৎ প্রবাহ থেকেই শনির গ্রহীয় চৌম্বক ক্ষেত্রের উদ্ভব ঘটেছে। এখনও পর্যন্ত শনির বাষট্টিটি উপগ্রহ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং তার মধ্যে তিপ্পান্নটির সরকারিভাবে নামকরণ করা হয়েছে। অবশ্য এগুলি ছাড়াও শনির শতাধিক গ্রহাণু আছে। সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপগ্রহ টাইটান শনির বৃহত্তম উপগ্রহ। এটি আকারে মঙ্গলের চেয়েও বড়ো এবং এটিই সৌরজগতের একমাত্র উপগ্রহ যার একটি সমৃদ্ধ বায়ুমণ্ডল আছে।শনিদেবকে নিয়ে বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ আছে।
গ্রিক পুরাণঃ-
—————–
আগে ছিল আদি জনক ও জননী। তাদের সন্তানরা হচ্ছে টাইটান আর দেবতারা হলেন তাদের নাতি নাতনী। টাইটানরা বড় দেবতাকূল। ক্রোনস প্রথম প্রজন্মের সর্বকনিষ্ঠ টাইটান, পিতা ইউরেনাসকে হত্যা করে দেবরাজ্য দখল করে ফেলে। তারপর তার পদ রক্ষার জন্য একে একে নিজের সব সন্তানকে খেয়ে ফেলে, কেবল জিউসকে ছাড়া। রোমানরা যখন গ্রিস দখল করে ক্রোনসের নাম বদল করে স্যাটার্ন রাখে। স্যাটার্ন থেকে শনি গ্রহ এবং স্যাটার ডে বা শনিবারের নামকরণ। পিতাকে ও নিজ সন্তানদের হত্যা এবং আরও অনেক রক্তপাত করার কারনে হয়তো এই দেবতার নামের সাথে খারাপ বা নেগেটিভ ধারণা চলে আসে।
স্কন্দ পুরাণঃ-
—————–
শিপ্রা ও ক্ষাতা নদীর সংযোগস্থলে জন্মগ্রহণ করেই শনি ত্রিলোক আক্রমণ করেন। আতঙ্কিত ইন্দ্র ছুটলেন ব্রহ্মার কাছে। নিরুপায় ব্রহ্মা সূর্যের কাছে। এর আগেই শনি দ্বারা আক্রান্ত সূর্য ব্রহ্মাকেই শনিকে সংযত করার অনুরোধ করলেন। ব্রহ্মা গেলেন বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণু গেলেন শিবের কাছে। শিব শনিকে ডেকে অত্যাচার করতে বারণ করলেন। তখন শনি শিবকে তাঁর জন্য খাদ্য, পানীয় ও বাসস্থানের উপায় করতে বললেন।শিব শনিকে মেষ থেকে মীন রাশিচক্রে ভ্রমণ করার ব্যবস্থা করে দিলেন। নিয়ম মত জন্মরাশি, দ্বিতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও দ্বাদশে শনি সর্বদাই ক্রুদ্ধ হবেন। কিন্তু তৃতীয়, ষষ্ঠ বা একাদশ স্থানে এলে তিনি উদার। পঞ্চম বা নবম স্থানে এলে তিনি উদাসীন। এই শনির আরেক নাম শনৈশ্চর। সন্তুষ্ট হলে তিনি লোককে দেবেন রাজ্য, অসন্তুষ্ট হলে নেবেন লোকের প্রাণ।
উক্ত পুরাণের নাগর ও প্রভাস খণ্ড মতে, অযোধ্যার জ্যোতিষীগণ দশরথকে সাবধান করে বলেছিলেন, শনিগ্রহ শীঘ্রই রোহিণী ভেদ করবেন। আর তার ফলে বারো বছর ধরে রাজ্যে ভীষণ অনাবৃষ্টি হবে। এই কথা শুনে ইন্দ্রের দেওয়া দিব্য রথে চড়ে দশরথ তৎক্ষণাৎ শনির পিছন ছুটলেন। সূর্য ও চন্দ্রের পথ অতিক্রম করে একেবারে নক্ষত্রমণ্ডলে গিয়ে শনির সামনে উপস্থিত হয়ে রাজা বললেন, “তুমি রোহিণীর পথ পরিত্যাগ কর। না করলে, আমি তোমাকে বধ করব।” শনি দশরথের এই রকম সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি রাজার পরিচয় জানতে চাইলে দশরথ আত্মপরিচয় দিলেন। শুনে শনি বললেন, “আমি তোমার সাহস দেখে অত্যন্ত প্রীত হয়েছি। আমি যার দিকে তাকাই, সেই ভস্ম হয়ে যায়। তবু তুমি প্রজাহিতের জন্য নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে আমার কাছে এসেছো, এতে আমি আরও বেশি খুশি হয়েছি। যাও, আমি কথা দিলাম, রোহিণীর পথ আমি আর কোনোদিনও ভেদ করব না।”
কালিকা পুরাণঃ-
———————-
সতীর দেহত্যাগের পর, মহাদেব তীব্র রোদন করতে থাকলে, তাঁর চোখ থেকে বিপুল পরিমাণ জলরাশি নির্গত হতে থাকে। এই জলরাশি পৃথিবীতে পতিত হলে- ভূমণ্ডল দগ্ধ হবে। এই কারণে দেবতাদের অনুরোধে শনি এই জল গ্রহণ করেন। কিন্তু শনি এই জল ধারণে অসমর্থ হয়ে জলধার নামক পর্বতে নিক্ষেপ করেন। এই জল পরে বৈতরণী নামে প্রবাহিত হয়েছে। [ ৯-৩৭। অষ্টাদশোহধ্যায়। কালিকা পুরাণ]
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণঃ-
———————–
একদিন শনির ধ্যানের সময়, তাঁর স্ত্রী সুন্দর বেশভূষা নিয়ে তাঁর কাছে এসে কামতৃপ্তি প্রার্থনা করলেন। ধ্যানমগ্ন শনি সেদিকে খেয়াল না করাতে অতৃপ্তকাম পত্নী শনিকে অভিশাপ দিলেন, আমার দিকে তুমি ফিরেও চাইলে না ! এরপর থেকে যার দিকে চাইবে, সে-ই ভস্ম হয়ে যাবে।
পুরানে কথিক আছে, একবার শনিদেবের প্রাণ বাঁচিয়ে ছিলেন হনুমান। প্রসন্ন শনিদেব জানিয়ে ছিলেন, হনুমানের সত্যিকারের ভক্তের তিনি কখনও কোনও ক্ষতি করবেন না।

Leave a Reply